Blog Post

বাংলাদেশের অদূর এবং সুদূর ভবিষ্যৎ

দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ভৌগোলিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে দেশ যে সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাকে অনেকেই ‘ক্রিটিকাল জাঙ্কচার’ বা ‘ভবিষ্যৎ নির্ধারণী’ সময় বলে মনে করছেন। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী এই সময়ে যে সিদ্ধান্তগুলো গৃহীত হচ্ছে, যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রশাসনিক কাঠামো ও সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি হচ্ছে তার প্রভাব দীর্ঘদিন বহাল থাকবে। একই সঙ্গে আগামীর বাংলাদেশের পথরেখার উত্থান-পতনও এই সময়ের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করছে। এই ভবিষ্যৎ নির্ধারণী সময়ে অনেক বিবেচ্য বিষয় সরকার ও জনগণের সামনে বাধা হিসেবে এলেও মোটামুটি কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করলেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে তার একটি চিত্র আঁকা যেতে পারে। সেগুলো হলো– আইনশৃঙ্খলা, বাজার ব্যবস্থা, জাতীয় নির্বাচন, প্রশাসনিক সংস্কার, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। 


অভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে আইনশৃঙ্খলার ওপর। এ সময় মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান কঠিন হয়। রাজনৈতিক বিরোধিতার বাইরেও ব্যক্তিগত শত্রুতায় সমাজে হানাহানি বেড়ে যায়। নতুন দায়িত্ব নেওয়া সরকারের পক্ষে অস্থির, অসহিষ্ণু ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী হঠকারীদের আটকানো কঠিন হয়ে যায়। ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে রাশিয়ান বিপ্লব, কিউবান, ইরানিয়ান এবং চায়না বিপ্লবেও অভ্যুত্থানের পর অনেক নিরপরাধ মানুষ মারা গিয়েছে, ক্ষতির শিকার হয়েছে। প্রতিবিপ্লব হয়েছে, ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে এবং আরেক দল লুটপাটের অজুহাত খুঁজে পেয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় অসংখ্য কল্যাণমুখী পদক্ষেপ ও গবেষণা হয়েছে, যাতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সেটি যে কোনো পরিস্থিতিতেই। যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে রাষ্ট্র গৃহযুদ্ধের দিকে যাবে। 


বাজার ব্যবস্থা এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়। বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে গোটা অর্থব্যবস্থা জড়িত। সুদূর ভবিষ্যতের ওপর তার প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে, এমনকি রাজস্বনীতি ও আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীদের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রেও। ব্যবসায়ীরা অনেকে চাঁদাবাজির কথাও বলছেন জোরেশোরে। অনেকে ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন এমন সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে। সুদূর ভবিষ্যতে এটিও ভয়ংকরভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যেতে পারে, যা একসময় বেকারত্ব, শ্রমিক শোষণ এমনকি খাদ্যাভাবের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। 


অন্তর্বর্তী সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত ও একটি উপযুক্ত সময়ে নির্বাচন আয়োজন করা এবং এর আগে যথাসম্ভব প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করে ফেলা। এটিও দুরূহ এবং বহুমাত্রিক বিষয়। একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সংস্কার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও খাতের সঙ্গে জড়িত। চাইলেই একটিকে রেখে আরেকটিকে সংস্কার করা যায় না। এ জন্য সময় নিয়ে দাপ্তরিক মিথস্ক্রিয়া, নির্ভরশীলতা ও প্রতিক্রিয়া যাচাই করাটা জরুরি। 


রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পথে বাধা তৈরি হলে তা দূর করে পথকে মসৃণ করা সরকারের দায়িত্ব। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যে আসতে চাওয়া মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। যখন সেই রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়, গণতন্ত্র নষ্ট হয় তখন নাগরিকের মাঝে ‘বঞ্চনার অনুভূতি’ জমতে থাকে, যা একসময় ভয়াবহভাবে বিস্ফোরিত হয়। এ কারণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ও বৈষম্য দূর করা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসা এই সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য। প্রত্যেকের সাংস্কৃতিক চর্চার স্বাধীনতা থাকা উচিত। সামাজিক অন্তর্ভুক্তি গণতন্ত্রের আরেক নিয়ামক। রাষ্ট্র সবাইকে রক্ষা করবে, সরকারবিরোধী হলেও তাকে আইনি আশ্রয় নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। সকলের রক্ষক রাষ্ট্র; এটি অনুধাবন করতে হবে। না হলে এক সময় মানুষের ভালোবাসা ক্রোধে পরিণত হবে। 


আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়েও এক ধরনের টানপোড়েন দেখা দিয়েছে। সত্যি বলতে জাতীয় স্বার্থের বাইরে ভাবার কোনো সুযোগ নেই আমাদের। এখন কোনটি জাতীয় স্বার্থ সেটি নির্ধারণ করাটাই জরুরি। ভারত বা পাকিস্তান, আমেরিকা বা চীন কেউই আমাদের স্থায়ী শত্রু না, কেউই স্থায়ী বন্ধু না। কারও সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকে যাকে আমাদের প্রয়োজন তাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা। কারও সঙ্গে অতি সখ্য, কারও সঙ্গে দূরত্ব যদি থেকেও থাকে, তা হবে সবার চোখের আড়ালে। তা নাগরিক পর্যায়ে উদযাপন করার বিষয় নয়। বহু বছর আগে চানক্য মন্তব্য করেছিলেন যে, ছোট রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে বড় রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হয়। এ কথাও ভুললে হবে না, বড়রা একসময় ঠিক সরে পড়ে, ছোটরা একা হয়ে যায়। সাহিত্যেও তো উল্লেখ আছে, বড়র পিরিতি বালির বাঁধ। যে ভবিষ্যৎ নির্ধারণী সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এ সময় ভুল করার সুযোগ নেই। 

মো: সুমন জিহাদী: পিএইচডি ফেলো, এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, থাইল্যান্ড


Get in touch

If you have any questions, need guidance, or wish to share suggestions, please don’t hesitate to reach out to me.